ঢাকা মহানগরীর আদি অঞ্চলটি মূলত পুরাণ ঢাকা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল এর সাথে পুরাণ ঢাকার পার্থক্য রয়েছে ভাষা, সংস্কৃতি, খাবার,ঐতিহ্য ও অন্যান্য অনেক দিক থেকে। পুরাণ ঢাকায় রয়েছে নানা দর্শনীয় স্থান। যা দেশের ও দেশের বাইরে সমানভাবে জনপ্রিয়। সেই সাথে এসকল দর্শনীয় স্থান নানা ইতিহাস বহন করে। সে সকল স্থানগুলোর মাঝে কিছু দর্শনীয় স্থানের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
লালবাগ কেল্লা: ঢাকার দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত একটি অসমাপ্ত দূর্গ।এটি নির্মাণ করেন সুবাদার আজম শাহ। মসজিদ, দেওয়ান -ই- আম,পরীবিবির সমাধি এই তিনটি অংশের সমন্বয়ে লালবাগ কেল্লাটি নির্মিত। মসজিদ টি নির্মাণ করেন শাহজাদা আজম। যা তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। দেওয়ান-ই-আম মূলত শায়েস্তা খাঁ বাসভবন ও বিচার কার্যের জন্য ব্যবহার করতেন। পরীবিবির সমাধি টি শায়েস্তা খান তার কন্যা পরীবিবির স্মরণে মাজারের আদলে নির্মাণ করেন। মাজারটি মুঘল আমলের নানা নিদর্শন বহন করছে। কারুকাজ খচিত নকশা এখনো জানান দেয় পূর্বে কতোটা চাকচিক্যময় ছিলো এটি ।এছাড়া,লালবাগ কেল্লায় বর্গাকৃতির পানির ট্যাংক রয়েছে। বর্তমানে জাদুঘর ও ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। জাদুঘরে রাখা আছে এখানে প্রাপ্ত মুঘল আমলের নানা নিদর্শন।
আহসান মঞ্জিল:পুরাণ ঢাকার ইসলামপুরের কুমারটুলি এলাকায় এর অবস্থান। জমিদার শেখ এনায়েতউল্লাম প্রথম এখানে রংমহল নির্মাণ করেন। তার ছেলে শেখ মতিউল্লাহ ফরাসি বণিকদের কাছে এটি বিক্রয় করে দেয়।১৮৩৫ সালে নবাব আলীমুল্লাহ এই ভবনটি ক্রয় করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। নবাব আবদুল গণি ১৮৭২ সালে নতুন করে এর নির্মাণ কাজ করেন এবং তার ছেলে খাজা আহসানুল্লার নামানুসারে এর নাম রাখেন আহসান মঞ্জিল। তৎকালীন সময়ে এর মতো ভবন পুরো ঢাকা জুড়ে ২য় টি ছিলো না। এর সুবিশাল গম্বুজ অনেক দূর থেকে দৃষ্টিগোচর হতো। এই অভ্যন্তর অংশে ২৩ টি কক্ষ রয়েছে।যা কয়েক হাজার নিদর্শন বহন করে আছে। এর অভ্যন্তরীণ কক্ষগুলো জলসাঘর, নাচেরঘর,থাকার ঘর,বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার,দরবার হল ইত্যাদি নানা কাজে ব্যাবহার হতো। ভবনটির সামনে রয়েছে সুবিশাল বাগান ও মাঠ। ১৯৯২ সাল থেকে এটি দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘর হিসেবে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
কার্জন হল:বৃটিশ স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন কার্জন হল।যা বহন করে আছে শতবছর এর ইতিহাস। দেশ ভাগ, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন,৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের নিরব সাক্ষী এ ভবন। ১৯০৪ সালে ভাইসরয় লর্ড কার্জন নাথানিয়েল এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ইউরোপ ও মুঘল স্থাপত্য রীতির মিশেলে এটি নির্মান করা হয়েছে। বাহ্যিক অংশ নির্মাণ হয়েছে উন্নতমানের লাল ইট দিয়ে যা একে আরো দৃষ্টিনন্দিত করেছে। সেই বৃটিশ আমল থেকে এখন অব্দি যতগুলো ভবন তাদের জৌলুস ধরে রেখেছে তার মাঝে অন্যতম হলো কার্জন হল। বর্তমানে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের পরীক্ষার হল ও শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয় এছাড়া এ স্থাপত্যশৈলী পরিদর্শন করতে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে প্রতিদিন লোক ভিড় করে।বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখোরিত থাকে সর্বদা।
বিউটি বোর্ডিং :পুরাণ ঢাকার বাংলা বাজারে ১নং শ্রীশদাস লেনে অবস্থিত দোতলা ভবনটি বিউটিবোর্ডিং নামে পরিচিত। যার সাথে মিশে আছে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির নানা ইতিহাস। ১৯৪৯ সালে প্রহ্লাদ সাহা ও তার ভাই নলিনী মোহন সাহা জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের কাছ থেকে জমি নিয়ে তাতে গড়ে তোলেন এই বিউটি বোর্ডিং। নলিনী মোহন এর বড় মেয়ে বিউটির নামানুসারে এর নাম রাখা হয় বিউটিবোর্ডিং। তৎকালীন সময়ের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির পদচারণায় মুখোরিত ছিলো বিউটি বোর্ডিং। পূর্বের মত জৌলস না থাকলেও এখনো বিউটি বোর্ডিং এ থাকা যায় এবং দুপুর ও রাতের খাবারের ও ব্যবস্থা রয়েছে।
রূপলাল হাউজ :পুরাণ ঢাকার শ্যামবাজারে জমিদার ও বণিকদের তৈরি একটি ভবন রূপলাল হাউজ। রূপলাল ও রঘুনাথ দুই ভাই আর্মেনিয়া জমিদার আরাতুনের কাছ থেকে বাড়িটি ক্রয় করে পুঃনসংস্কার করেন।১৯৪৭ সালে রূপলাল এর উত্তরাধিকারীরা ভারতে চলে যায়। সাম্প্রতিকালে মসলা ও সবজি ব্যবসায়ীদের দখল থেকে সরকার পুরাতত্ত্ব বিভাগ কে এর দায়িত্ব হস্তান্তরে করে।